জীবমাত্রই খাদ্য গ্রহণ করে, কারণ জীবের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। তবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া ভিন্ন। জীবের পুষ্টির জন্য বিভিন্ন উপাদানের প্রয়োজন হয়। মানবদেহের জন্য খাদ্য, পুষ্টি ও পরিপাক প্রক্রিয়া এবং উদ্ভিদের পুষ্টি এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ।
উদ্ভিদ তার বৃদ্ধি ও পরিপুষ্টির জন্য মাটি, বায়ু এবং পানি থেকে কতগুলো উপাদান গ্রহণ করে। এ উপাদানগুলোর অভাবে উদ্ভিদ সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে পারে না। এ উপাদানগুলোকে উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান বলে। এ সকল পুষ্টি উপাদানের অধিকাংশই উদ্ভিদ মাটি থেকে সংগ্রহ করে বলে এদেরকে খনিজ পুষ্টি বলা হয়। উদ্ভিদে প্রায় 60 টি অজৈব উপাদান শনাক্ত করা হয়েছে, তবে এই 60 টি উপাদানের মধ্যে মাত্র 16 টি উপাদান উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়। এ 16 টি পুষ্টি উপাদানকে সমষ্টিগতভাবে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান (essential elements) বলা হয়। এই উপাদানগুলো সব ধরনের উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, শারীরবৃত্তীয় কাজ এবং প্রজননের জন্য প্রয়োজন। এদের যেকোনো একটির অভাব হলে উদ্ভিদে তার অভাবজনিত লক্ষণ (deficiency symptoms) দেখা দেয় এবং পুষ্টির অভাবজনিত রোগের সৃষ্টি হয়। একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদানের কাজ অপরটি দিয়ে সম্পন্ন হয় না।
অত্যাবশ্যকীয় 16 টি উপাদানের মধ্যে উদ্ভিদ কোনো কোনো উপাদান বেশি পরিমাণে গ্রহণ করে, আবার কোনো কোনো উপাদান সামান্য পরিমাণে গ্রহণ করে। উদ্ভিদ কর্তৃক গৃহীত অত্যাবশ্যকীয় খনিজ পুষ্টির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে এদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান এবং মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান ।
(a) ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান (macro - nutrient বা macro-element): উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যেসব উপাদান বেশি পরিমাণে দরকার হয়, সেগুলোকে ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা ম্যাক্রো উপাদান বলা হয়। ম্যাক্রো উপাদান 10 টি, যথা: নাইট্রোজেন (N), পটাশিয়াম (K), ফসফরাস (P), ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O), সালফার (S) এবং লৌহ (Fe)।
(b) মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান (micro-nutrient বা micro-element): উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য যেসব উপাদান অত্যন্ত সামান্য পরিমাণে প্রয়োজন হয় তাদেরকে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট বা মাইক্রো উপাদান বলে। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট 6 টি, যথা: দস্তা বা জিংক (Zn), ম্যাংগানিজ (Mn), মোলিবডেনাম (Mo), বোরন (B), তামা বা কপার (Cu) এবং ক্লোরিন (Cl) ।
পুষ্টি উপাদানের উৎস
উদ্ভিদ পুষ্টি উপাদানগুলোর মধ্যে কার্বন এবং অক্সিজেন বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রহণ করে। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন পানি থেকে গ্রহণ করে। অন্যসব উপাদান মাটি থেকে মূলের সাহায্যে শোষণ করে। এ উপাদানগুলো মাটিতে বিভিন্ন লবণ হিসেবে থাকে। কিন্তু উদ্ভিদ এগুলোকে লবণ হিসেবে সরাসরি শোষণ করতে পারে না, আয়ন হিসেবে শোষণ করে। যেমন: Ca++, Mg++, NH4+, NO3-, K+ ইত্যাদি।
উদ্ভিদের পুষ্টিতে বিভিন্ন খনিজ উপাদানের ভূমিকা
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন খনিজ পুষ্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টের ভূমিকার কথা নিচে বর্ণনা করা হলো।
নাইট্রোজেন : নাইট্রোজেন নিউক্লিক অ্যাসিড, প্রোটিন আর ক্লোরোফিলের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। উদ্ভিদের সাধারণ দৈহিক বৃদ্ধিতে নাইট্রোজেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং কোষ কলায় পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। নাইট্রোজেনের অভাব হলে ক্লোরোফিল সৃষ্টি ব্যাহত হয়, আর ক্লোরোফিল সৃষ্টি ব্যাহত হলে খাদ্য প্রস্তুত বাধাপ্রাপ্ত হয়। খাদ্যপ্রস্তুত বাধাপ্রাপ্ত হলে শ্বসন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটে এবং শক্তি নির্গমন হ্রাস পায়।
ম্যাগনেসিয়াম: ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরোফিল অণুর একটি গুরুত্বপুর্ণ উপাদান এবং শ্বসন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। এর অভাব হলে ক্লোরোফিল অণু সৃষ্টি এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত ব্যাহত হবে।
পটাশিয়াম: উদ্ভিদের বহু জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় পটাশিয়াম সহায়ক হিসেবে কাজ করে। পত্ররন্ধ্র খেলা এবং বন্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে পটাশিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। পটাশিয়াম উদ্ভিদে পানি শোষণে সাহায্য করে। কোষবিভাজনের মাধ্যমে উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে পটাশিয়াম। এটি মূল, ফুল ও ফল উৎপাদন এবং বর্ধনেও সাহায্য করে।
ফসফরাস: মূল বর্ধনের জন্য ফসফরাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান। ফসফরাস জীবকোষের DNA, RNA, NADP, ATP প্রভৃতির গাঠনিক উপাদান। কাজেই এটি ছাড়া উদ্ভিদের পুষ্টি একেবারেই সম্ভব নয়। উদ্ভিদের মূল বৃদ্ধির জন্য ফসফরাস অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান।
আয়রন: আয়রন সাইটোক্রোমের সাংগঠনিক উপাদান, কাজেই বায়বীয় শ্বসন এর উপর নির্ভরশীল। ক্লোরোফিল সৃষ্টিতেও আয়রনের ভূমিকা অপরিসীম।
পুষ্টিতে এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্যই আমরা ভালো ফলন পেতে জমিতে নাইট্রোজেন (ইউরিয়া), পটাশিয়াম (মিউরেট অফ পটাশ), ফসফরাস (ট্রিপল সুপার ফসফেট) প্রভৃতি সার ব্যবহার করে থাকি ।
উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট গুলোও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন:
ম্যাংগানিজ: ক্লোরোপ্লাস্ট গঠন ও সংরক্ষণের জন্য ম্যাংগানিজ প্রয়োজন।
কপার: টমেটো, সূর্যমুখী উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য কপার বা তামার প্রয়োজন, শ্বসন পক্রিয়ার উপরও কপারের প্রভাব উল্লেখযোগ্য ।
বোরন: উদ্ভিদের সক্রিয়ভাবে বর্ধনশীল অঞ্চলের জন্য বোরন প্রয়োজন, চিনি পরিবহনে বোরন পরোক্ষ প্রভাব বিস্তার করে।
মোলিবডেনাম: অণুজীব দিয়ে বায়বীয় নাইট্রোজেন সংবন্ধনের জন্য মোলিবডেনাম আবশ্যক।
ক্লোরিন: সুগারবিট এর মূল এবং কাণ্ডের বৃদ্ধির জন্য ক্লোরিন প্রয়োজন।
উদ্ভিদের কোনো পুষ্টি উপাদানের অভাব হলে বিশেষ লক্ষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ তা প্রকাশ করে। এ লক্ষণগুলোকে বলা হয় অভাবজনিত লক্ষণ (deficiency symptoms)। এ লক্ষণ দেখে আমরা বুঝতে পারি কোন উদ্ভিদ বা ফসলে কোন পুষ্টি উপাদানের অভাব রয়েছে। নিচে কিছু উপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ উল্লেখ করা হলো
অভাবজনিত লক্ষণ | রোগাক্রান্ত উদ্ভিদ |
নাইট্রোজেন (N): নাইট্রোজেনের অভাব হলে ক্লোরোফিল সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটে। ক্লোরোফিলের অভাবে পাতার সবুজ রং হালকা হতে হতে একসময় হলুদ হয়ে যায়। তার কারণ ক্লোরোফিল ছাড়া অন্যান্য বর্ণকণা বা পিগমেন্ট মিলিতভাবে হলুদ দেখায়। পাতা হলুদ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে 'ক্লোরোসিস' ( chlorosis) বলে। লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ বা দস্তার অভাবেও ক্লোরোসিস হতে পারে কেননা এগুলোও ক্লোরোফিল | উৎপাদনের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ক্লোরোসিসে কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজন হ্রাস পায়, তাই উদ্ভিদের বৃদ্ধি কমে যায়। চিত্রে যথাক্রমে নাইট্রোজেনের ঘাটতিবিশিষ্ট এবং সুস্থ পাতা দেখানো হয়েছে।
|
|
ফসফরাস (P): ফসফরাসের অভাব হলে পাতা বেগুনি হয়ে যায়। পাতায় মৃত অঞ্চল সৃষ্টি হয় এমনকি পাতা, ফুল ও ফল ঝরে যেতে পারে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় এবং উদ্ভিদ খর্বাকার হয়। বেশিরভাগ সময় খালি চোখে দেখে ফসফরাসের ঘাটতি বোঝা যায় না। যত দিনে লক্ষণ দৃশ্যমান হয়, তত দিনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর তেমন কিছু করার থাকে না। | |
পটাশিয়াম (K) : পটাশিয়ামের অভাবে পাতার শীর্ষ এবং কিনারা হলুদ হয় এবং মৃত অঞ্চল সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পাতার শিরার মধ্যবর্তী স্থানে ক্লোরোসিস হয়ে হলুদবর্ণ ধারণ করে। পাতার কিনারায় পুড়ে যাওয়া সদৃশ বাদামি রং দেখা যায় এবং পাতা কুঁকড়ে আসে। উদ্ভিদের বৃদ্ধি কম হয় এবং শীর্ষ ও পার্শ্ব মুকুল মরে যায় । | |
ক্যালসিয়াম (Ca): কোষের সাইটোসলে ক্যালসিয়ামের স্বাভাবিক মাত্রা, মাইটোকন্ড্রিয়া এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের স্বাভাবিক কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত। মাত্রা কমে গেলে মাইটোকন্ড্রিয়ায় অক্সিডেটিভ ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়া এবং এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের প্রোটিন ট্রাফিকিং প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়। তাই ক্যালসিয়ামের অভাবে উদ্ভিদের বর্ধনশীল শীর্ষ অঞ্চল, বিশেষ করে পাতার কিনারা বরাবর অঞ্চলগুলো মরে যায়। পাতা কুঁকড়ে যায়, ফুল ফোটার সময় উদ্ভিদের কাণ্ড শুকিয়ে যায় এবং উদ্ভিদ হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। | |
ম্যাগনেসিয়াম (Mg) : ম্যাগনেসিয়ামের অভাবে ক্লোরোফিল সংশ্লেষিত হয় না বলে সবুজ রং হালকা হয়ে যায় এবং সালোকসংশ্লেষণের হার কমে যায়। পাতার শিরাগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে অধিক হারে ক্লোরোসিস হয়। | |
লৌহ (Fe): লৌহের অভাবে প্রথমে কচি পাতার রং হালকা হয়ে যায়, তবে পাতার সরু শিরার মধ্যবর্তী স্থানেই প্রথম হালকা হয় এবং ক্লোরোসিস হয়। কখনো কখনো সম্পূর্ণ পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়। কাণ্ড দুর্বল এবং ছোট হয়। | |
সালফার (S): সালফার উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রোটিন, হরমোন ও ভিটামিনের গাঠনিক উপাদানই শুধু নয়, একই সাথে এটি কোষে পানির সমতা রক্ষা করে। সালফারের অভাবে পাতা হালকা সবুজ হয় এবং পাতায় লাল ও বেগুনি দাগ দেখা যায়। কচি পাতায় বেশি এবং বয়োবৃদ্ধ পাতায় কম ক্লোরোসিস হয়। সালফারের অভাবে মূল, কাণ্ড এবং পাতার শীর্ষ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে টিস্যু মারা যেতে থাকে, যাকে ডাইব্যাক (dieback) বলে। কাণ্ডের মধ্যপর্ব ছোট হয় বলে গাছ খর্বাকৃতির হয়। | |
বোরন ( B ): বোরন কোষপ্রাচীরের কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে প্রাচীরটিকে তথা কোষটিকে দৃঢ়তা দেয়। বিপাক ক্রিয়ার বিভিন্ন বিক্রিয়ার এর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা রয়েছে। তাই বোরনের অভাবে পর্যাপ্ত দৃঢ়তা না পেয়ে এবং বিপাকে গোলযোগ হওয়ার কারণে উদ্ভিদের বর্ধনশীল অগ্রভাগ মরে যায়। কচি পাতার বৃদ্ধি কমে যায় এবং পাতা বিকৃত হয়, কাণ্ড খসখসে হয়ে ফেটে যায়। ফুলের কুঁড়ির জন্ম ব্যাহত হয়। |
একক কাজ |
কাজ: কোন কোন খনিজ মৌলের অভাবে গাছে কী কী অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়, শিক্ষক তার একটি তালিকা শিক্ষার্থীদেরকে তৈরি করতে বলবেন। |
তোমরা ষষ্ঠ এবং অষ্টম শ্রেণিতে জেনেছ, জীবনধারণের জন্য খাদ্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য প্রয়োজন। এই খাদ্যই জীবকোষে জারিত হয়ে দেহে তাপ এবং শক্তি তৈরি করে। ভোমরা এর আগের অধ্যায়ে শ্বসন প্রক্রিয়ায় কীভাবে জীবদেহের ভিতরে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভাগ এবং শক্তি উৎপন্ন হয় সেটা জেনেছ। চলাফেরা, খেলাধূলা ইত্যাদি সব কাজে শক্তির প্রয়োজন। আমরা এই শক্তি পাই খাদ্য থেকে। যেসব বস্তু খাওয়ার পর দেহে শোষিত হয়ে বিভিন্ন কার্য সম্পাদন করে, তাকে খাদ্য বলে। এই কাজগুলো হচ্ছে দেহের পুষ্টিসাধন, দেহের ক্ষয়পূরণ, দেহে রোগ প্রতিরোধক শক্তি উৎপাদন এবং কর্মপত্তি ও তাপ উৎপাদন ।
সম্মিলিতভাবে আগে উল্লিখিত কাজগুলো আমাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন। এ কাজগুলো সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন খাদ্য উপাদানের দরকার হয়। খাদ্য অনেকগুলো রাসায়নিক বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত। এই রাসায়নিক কতগুলোকে খাদ্য উপাদান বলে। এই উপাদানগুলোর মধ্যে পুষ্টি থাকে, তাই খাদ্য উপাদানকে পুষ্টি উপাদানও বলা হয়। অধিকাংশ খাদ্যে একাধিক খাদ্য উপাদান থাকে। কোনো খাদ্যে যে উপাদানটি বেশি পরিমাণে থাকে, তাকে সেই উপাদানের খাদ্য হিসেবে শ্রেণিভূক্ত করা হয়। উপাদান অনুযায়ী খাদ্যবস্তুকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
(a) আমিষ: দেহের বৃদ্ধিসাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে ।
(b) শর্করা: দেহে শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।
(c) স্নেহ ও চর্বিজাতীয় খাদ্য: দেহে তাপ এবং শক্তি উৎপাদন করে । এছাড়া আরও তিন ধরনের উপাদানও দেহের জন্য প্রয়োজন। যেমন:
(d) খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন: রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায় এবং বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উদ্দীপনা যোগায়।
(e) খনিজ লবণ: বিভিন্ন জৈবিক কাজে অংশ নেয়।
(f) পানি: দেহে পানি এবং তাপের সমতা রক্ষা করে, এছাড়া কোষের কার্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোষ ও তার অঙ্গাণুগুলোকে ধারণ করে।
উপরে উল্লেখ করা খাদ্য উপাদানের বাইরে আরও একটি উপাদান রয়েছে, যেটি কোনো পুষ্টি না জোগালেও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান।
(g) गाচ্চ আঁশ (Fibre) বা রাকেন্দ্র: রাফেজ পানি শোষণ করে এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও বৃহদন্ত্র থেকে মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে।
(a) আমিষ (Protein)
আমিষ বা প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত। আমিষে শতকরা 16 ভাগ নাইট্রোজেন থাকে। আমিষে সামান্য পরিমাণে সালফার, ফসফরাস এবং আয়রনও থকে। নাইট্রোজেন এবং শেষোক্ত উপাদানগুলোর উপস্থিতির কারলে আমিষের পুরুত্ব শর্করা ও স্নেহ পদার্থ থেকে আলাদা। শুধু আমিষজাতীয় খাদ্যই শরীরে নাইট্রোজেন সরবরাহ করে বলে পুষ্টিবিজ্ঞানে আমিষকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আমিষের উৎস: আমরা আগেই জেনেছি মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, শিমের বীচি, শুটকি মাছ, চিনাবাদাম ইত্যাদি থেকে আমরা আমিষ পাই। উৎস অনুযায়ী আমিষ দুই ধরনের: প্রাণিজ আমিষ এবং উদ্ভিজ্জ আমিষ।
প্রাণিজ আমিষ: মাছ, মাংস, ডিম, পনির, ছানা, কলিজা বা যকৃৎ ইত্যাদি প্রাণিজ আমিষ। এসব খাদ্যে দেহের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায় ।
উদ্ভিজ্জ আমিষ: ডাল, চিনাবাদাম, শিমের বীচি ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ আমিষ। একসময় ধারণা করা হতো এগুলো প্রাণিজ আমিষের তুলনায় কম পুষ্টিকর, কারণ উদ্ভিজ আমিষে প্রয়োজনীয় সব কয়টি অ্যামাইনো এসিড থাকে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্ভিজ্জ আমিষ প্রাণিজ আমিষের মতোই সকল অ্যামাইনো এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে ধারণ করে। চিত্র 5.01: আমিষাতীয় খাদ্য অনেক সময়, দুই বা ততোধিক উদ্ভিজ আমিষ একত্রে রান্না করা যায়। কিন্তু এতে অ্যামাইনো এসিডের অনুপাতের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় না।
(b) শর্করা বা কার্বোহাইড্ৰেট (Carbohydrate) শর্করাজাতীয় খাদ্য শরীরে কাজ করার শক্তি যোগায়। শর্করার মৌলিক উপাদান কার্বন, হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন। উদ্ভিদের মূল, কান্ড, পাতা, ফুল, ফল ও বীজে শর্করা বিভিন্নরূপে জমা থাকে। ফলের রসে গ্লুকোজ, দুধে ল্যাকটোজ, গম, আলু, চাল ইত্যাদিতে শ্বেতসার (স্টার্চ) ইত্যাদি শর্করাজাতীয় খাদ্যের বিভিন্ন রূপ। গঠনপদ্ধতি অনুসারে শর্করাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। নিচের সারণিতে এই তিন ধরনের শর্করার গঠন এবং উৎস দেখানো হলো।
শর্করা শ্রেণি | পঠন | উদাহরণ | উৎস |
এক শর্করা (Mono-saccharide) | একটি মনোমার বিশিষ্ট গ্লুকোজ শর্করা | গ্লুকোজ | মধু, ফলের রস |
দ্বি-শর্করা (Disaccha- ride) | দুইটি মনোমারবিশিষ্ট (পলিমার) শর্করা | সুক্রোজ, ল্যাকটোজ | চিনি ও দুধ |
বহু শর্করা (Polysac- charide) | বহু মনোমারবিশিষ্ট (পলিমার) শর্করা | শ্বেতসার, গ্লাকোজেন | চাল, আটা, আলু, সবুজ শাক-সবজি ইত্যাদি। |
প্রধানত চাল, গম, আলু থেকে আমরা শ্বেতসার পাই। কাঁচা খাদ্যের শ্বেতসার সহজে হজম হয় না। এজন্য আমরা চাল, আটা, আলু ইত্যাদি রান্না করে খাই। খাওয়ার পর শর্করা পরিপাক হয়ে গ্লুকোজে পরিণত হয়। দ্বি-শর্করা এবং বহু শর্করা পরিপাকের মাধ্যমে সরল শর্করায় পরিণত হয়ে দেহে শোষণযোগ্য হয়। মানব পরিপুষ্টির জন্য সরল শর্করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানবদেহ শুধু সরল শর্করা শোষণ করতে পারে।
(c) স্নেহজাতীয় খাদ্য (Fats)
চর্বি একটি প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন দিয়ে তৈরি এই উপাদানটির মুখ্য কাজ হলো তাপ উৎপাদন করা। এই উপাদানটি পাকস্থলীতে অনেকক্ষণ থাকে, তাই তখন ক্ষুধা পায় না। দেহের ত্বকের নিচে চর্বি জমা থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ যেমন: যকৃৎ, মস্তিষ্ক, মাংস পেশিতেও চর্বি জমা থাকে। দেহের এ সঞ্চিত চর্বি উপবাসের সময় কাজে লাগে।
শর্করা ও আমিষের তুলনায় চর্বিতে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ক্যালরি থাকে (ক্যালরি হলো প্রাণিদেহে শক্তি মাগার একটি একক)। খাবার তেল বা ঘি দিয়ে রান্না করা খাবার বেশ সুস্বাদু হয়, সঙ্গে এর পুষ্টিমানও বেড়ে যায়। যেমন সিদ্ধ আলুর চেয়ে ভাজা আলু, রুটির চেয়ে লুচি বা পরোটা শুধু মুখরোচকই নয়, এতে ক্যালরিও বেশি পাওয়া যায়। কোনো কোনো চর্বিতে ভিটামিন 'এ' আছে, আবার কোনোটিতে আছে ভিটামিন 'ই'।
উৎস অনুযায়ী স্নেহপদার্থ দুই ধরনের, উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ এবং প্রাণিজ স্নেহপদার্থ।
উদ্ভিজ্জ স্নেহপদার্থ: সয়াবিন, সরিষা, তিল, বাদাম, সূর্যমুখী এবং ভুট্টার তেল ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন তেল উৎকৃষ্টতম ।
প্রাণিজ স্নেহপদার্থ: চর্বি, ঘি, ডালডা ইত্যাদি প্রাণিজ স্নেহপদার্থ। ডিমের কুসুমে স্নেহপদার্থ আছে, কিন্তু সাদা অংশে স্নেহপদার্থ থাকে না। স্নেহপদার্থ পানিতে অদ্রবণীয়। পানির চেয়ে হালকা বলে পানির উপর ভাসে। একজন সুস্থ সবল পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দিনে 50-60 গ্রাম চর্বির প্রয়োজন হয়।
(d) খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন (Vitamins )
স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিনের পরিমাণ খুব সামান্য হলেও এর পুরুত্ব অপরিসীম। দেহের বৃদ্ধির জন্য ও সুস্থ থাকার জন্য ভিটামিন অত্যাবশ্যক। সুষম খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উপাদান থাকে বলে সুষম খাদ্য থেকে প্রচুর ভিটামিন পাওয়া যায়। তবে নিয়মিত ভিটামিনবিহীন খাবার খেলে কিছুদিনের মধ্যে দেহে ভিটামিনের অভাবজনিত সমস্যা দেখা দেয়। পরবর্তীকালে তা মারাত্মক আকারে স্থায়ীভাবে দেহের ক্ষতিসাধন করে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ভিটামিনকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন এবং পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন।
চর্বিতে এবণীয় ভিটামিন ভিটামিন
ভিটামিন A: দুধ, মাখন, চর্বি, ডিম, পাজর, আম, কাঁঠাল, রঙিন শাকসবজি, মলা মাছ ইত্যাদিতে ভিটামিন 'এ' পাওয়া যায়।
ভিটামিন D: দুধ, ডিম, কপিল বা যকৃৎ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মাছের তেল, ভোজ্য তেল ইত্যাদিতে ভিটামিন 'ডি' থাকে।
ভিটামিন E এবং K: উপরে উল্লিখিত সব খাবার থেকে ভিটামিন 'ই' এবং 'কে' পাওয়া যায়।
পানিতে দ্রবণীয় ভিটামিন
ভিটামিন B: ইস্ট, ঢেকিছাঁটা চাল, জাঁতায় ভাঙা আটা বা লাল আটা, অঙ্কুরিত ছোলা, মুগডাল, মটর, ফুলকপি, চিনাবাদাম, শিমের বীচি, কলিজা বা যকৃৎ, হৃৎপিণ্ড, দুধ, ডিম, মাংস, সবুজ শাকসবজি ইত্যাদিতে ভিটামিন 'বি' থাকে। ভিটামিন C: পেয়ারা, বাতাবি লেবু, কামরাঙা, কমলা, আমড়া, বাঁধাকপি, টমেটো, আনারস, কাঁচামরিচ, তাজা শাকসবজি ইত্যাদি থেকে ভিটামিন 'সি' পাওয়া যায়।
(e) খনিজ লবণ (Mineral salts)
দেহকোষ ও দেহের তরল অংশের জন্য খনিজ লবণ অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। মানুষের শরীরে ক্যালসিয়াম, লৌহ, সালফার, দস্তা, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়োডিন ইত্যাদি থাকে। এ উপাদানগুলো কখনো মৌলিক উপাদানরূপে মানবদেহে অবস্থান করে না, এগুলো খাদ্য ও মানবদেহে বিভিন্ন পরিমাণে অন্য পদার্থের সাথে মিলিত হয়ে নানা জৈব এবং অজৈব যৌগের লবণ তৈরি করে। খনিজ লবণ দেহ গঠন ও দেহের অভ্যন্তরীণ কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। হাড়, দাঁত, পেশি, এনজাইম এবং হরমোন গঠনের জন্য খনিজ লবণ একটি অপরিহার্য উপাদান। স্নায়ুর উদ্দীপনা, পেশি সংকোচন, দেহকোষে পানির সাম্যতা বজায় রাখা, অম্ল ও ক্ষারের সমতাবিধান, এসব কাজে খনিজ লবণের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
দুধ, দই, ছানা, পনির, ছোট মাছ (মলা-ঢেলা), নানা রকম ডাল, সবুজ শাকসবজি, ঢেঁড়স, লাল শাক, কচু শাক ইত্যাদি ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস। কলিজা, সবুজ শাকসবজি, মাংস, ডিমের কুসুম, কচু শাক ইত্যাদিতে লৌহ থাকে। দুধ, মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল থেকে ফসফরাস পাওয়া যায়। খাবার লবণ, চিপস, নোনতা খাবার, পনির, বাদাম, আচার ইত্যাদিতে সোডিয়াম থাকে। মাছ, মাংস, বাদাম, ডাল, কলা, আলু, আপেল ইত্যাদিতে পটাশিয়াম থাকে। আয়োডিনের উৎস হলো সামুদ্রিক উদ্ভিদ ও মাছ, মাংস এবং শেওলা।
(f) পানি (Water)
পানির অপর নাম জীবন। জীবনরক্ষার কাজে অক্সিজেনের পরেই পানির স্থান। দেহের পুষ্টির কাজে পানি অপরিহার্য। দেহের গঠন ও অভ্যন্তরীণ কাজ পানি ছাড়া চলতে পারে না। মানবদেহে পানির কাজগুলোকে তিন ভাগ করা যায়, দেহ গঠন, দেহের অভ্যন্তরীণ কার্য নিয়ন্ত্রণ এবং দেহ থেকে দূষিত পদার্থ নির্গমন।
দেহ গঠন: দেহকোষের গঠন এবং প্রতিপালন পানি ছাড়া কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। গড়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈহিক ওজনের 50%-65% পানি।
দেহের অভ্যন্তরীণ কার্য নিয়ন্ত্রণ: পানি ব্যতীত দেহের অভ্যন্তরের কোনো রাসায়নিক ক্রিয়া চলতে পারে না। দেহে পানি দ্রাবকরূপে কাজ করে। পানির জন্যই দেহে রক্তসঞ্চালন সম্ভব। রক্তে পরিবাহিত খাদ্য উপাদান এবং অক্সিজেন পানির মাধ্যমে দেহকোষে পৌঁছাতে পারে। দেহের সকল ধরনের রসে খনিজ লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। পরিপাককৃত খাদ্য উপাদান পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় ক্ষুদ্রান্ত্রের মধ্য দিয়ে রক্তে বিশোষিত হয় । দূষিত পদার্থ নির্গমন: পানি দেহের দূষিত পদার্থ অপসারণে সাহায্য করে। মলমূত্র, ঘাম ইত্যাদি দূষিত পদার্থের সাথে দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়।
এভাবে প্রতিদিন দেহ থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি নির্গত হয়। তাছাড়া বয়স, আবহাওয়া, পরিশ্রম, খাওয়ার অভ্যাস ইত্যাদি বিষয়গুলো পানির চাহিদাকে প্রভাবিত করে। তাই একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক 2 লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। যেমন: কোনো ব্যক্তির দৈনিক ক্যালরি চাহিদা 2000 কিলোক্যালরি হলে, তার দৈনিক 2 লিটার পানির প্রয়োজন হয়।
(g) খাদ্য আঁশ (Fibre) বা রাফেজ
শস্যদানার বহিরাবরণ, সবজি, ফলের খোসা, শাঁস, বীজ এবং উদ্ভিদের ডাঁটা, মূল ও পাতায় আঁশ থাকে। এগুলে মূলত কোষপ্রাচীরের সেলুলোজ এবং লিগনিন। হাড় যেমন মানবদেহের কাঠামো তৈরি করে, সেলুলোজ এবং রাফেজ তেমনি উদ্ভিদের কাঠামো তৈরি করে। এগুলো জটিল শর্করা। গবাদিপশু, যেমন: গরু, ছাগল,মহিষ ইত্যাদি সেলুলোজ হজম করতে পারে। কিন্তু মানুষ এগুলো হজম করতে পারে না। রাফেজ পানি শোষণ করে এবং মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ও বৃহদন্ত্র থেকে মল নিষ্কাশনে সাহায্য করে। রাফেজযুক্ত খাবার বিষাক্ত বর্জনীয় বস্তুকে খাদ্যনালি থেকে পরিশোষণ করে। ধারণা করা হয়, এরূপ খাবার খাদ্যনালির ক্যান্সারের আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস করে। আঁশযুক্ত খাবার স্থূলতা হ্রাস, ক্ষুধাপ্রবণতা এবং চর্বি জমার প্রবণতা হ্রাসে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাবার তালিকায় যেসব খাবার থাকে তা 5.4 নং চিত্রে পিরামিডের আকারে দেখানো হলো। খেয়াল করে দেখ, পিরামিডের অংশগুলো তার আকার অনুযায়ী নিচের দিকে চওড়া এবং উপরের দিকে সরু। সবচেয়ে চওড়া অংশে ভাত, আলু, রুটি এসব। এগুলো বেশি করে খেতে হবে। তার পরের অংশে আছে শাকসবজি এবং ফলমূল। এসব ভাত, রুটির চেয়ে কম খেতে হবে। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, পনির, ছানা, দই আরও কম পরিমাণে খেতে হবে। তেল, চর্বি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার সবচেয়ে কম খাওয়া উচিত। আমাদের প্রতিদিনের খাবার এই খাদ্য পিরামিড অনুযায়ী বেছে নিতে হবে, তবেই আমরা সহজে সুষম খাদ্য নির্বাচন করতে পারব। কোনো কিছু খেতে ভালো লাগলে আমরা অনেক সময় বেশি খেয়ে নেই, সুস্বাস্থ্যের জন্য এ অভ্যাস ভালো নয়। তাই আমাদের সবারই পরিমিত পরিমাণ
খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, সেই সঙ্গে খাদ্য গ্রহণের নিয়মনীতি এবং সময় মেনে চলতে হবে।
খাদ্য উপাদান বাছাই করা, সুষম খাদ্য নির্বাচন করা ও সুষম আহার করা উন্নত জীবনযাপনের একটি পূর্বশর্ত। এ জন্য খাদ্যগ্রহণ নীতিমালা বা নিয়মনীতি প্রত্যেকের জানা প্রয়োজন। নীতিমালা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকলে খাদ্য নির্বাচন, খাদ্যের পুষ্টিমান, ক্যালরি, পারিবারিক আর ইত্যাদি সম্পর্কে নজর রেখে পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের খাদ্যের চাহিদা মেটানো সহজ হয়।
সুষম খাদ্যের বৈশিষ্ট্য
(a) একজন মানুষের বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উপাদানের সামর্থ্য থাকতে হবে।
(b) শর্করা, আমিষ এবং চর্বি নির্দিষ্ট অনুপাতে পরিমাণ মতো গ্রহণ করতে হবে।
(c) খাদ্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও রাফেজ বা সেলুলোজ (ফাইবার) সরবরাহের জন্য সুষম খাদ্য তালিকায় ফল ও টাটকা শাকসবজি থাকতে হবে।
(d) খাদ্যে অবশ্যই প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি ও খনিজ লবণ থাকতে হবে।
(e) সুষম খাদ্য অবশ্যই সহজপাচ্য হতে হবে।
সুস্থ, সবল ও উন্নত জীবনযাপনের জন্য সুষম খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। দেহের পরিপুষ্টির জন্য ছয় উপাদানবিশিষ্ট খাদ্য অন্তর্ভুক্ত করে সুষম খাদ্যের তালিকা বা মেনু পরিকল্পনা করা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দেহের চাহিদা, খাদ্যের সহজলভ্যতা এবং পারিবারিক আয়, এ তিনটি বিষয় বিবেচনা করে খাদ্য উপাদান বাছাই বা মেনু পরিকল্পনা করলে তা বাস্তবমুখী হয়। কম দামি খাবার দিয়ে সমান পুষ্টিমানের মেনু পরিকল্পনা করা যায়; তাই সমমানের উপাদান-সংবলিত বেশি দামের খাদ্যের পরিবর্তে কম দামি খাদ্য নির্বাচন করে সুষম খাদ্য গ্রহণের মানসিকতা থাকা ভালো।
সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরি
সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরির জন্য কতগুলো বিষয়ের দিকে বিশেষ লক্ষ রাখা প্রয়োজন। যেমন :
নিচের সারণিগুলো পর্যবেক্ষণ কর। এ থেকে তোমরা বিভিন্ন বয়সী মানুষের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ও ক্যালরি চাহিদা সম্পর্কে ধারণা পাবে।
তালিকা (a): পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ও নারীর জন্য সুষম খাদ্যতালিকা
পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ও নারীর দেহে প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার ক্যালরি পেতে হলে তালিকায় উল্লিখিত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। গর্ভবতী এবং স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য অতিরিক্ত খাদ্যের প্রয়োজন হবে। কিশোর ও যুবা বয়সী ছেলেমেয়েদের বয়স অনুযায়ী পরিমাণে একটু কম খেলেও চলবে।
পূর্ণবয়স্ক পুরুষ | পূর্ণবয়স্ক নারী |
খাদ্যশস্যের নাম |
পরিশ্রমহীন (গ্রাম) |
মোটামুটি পরিশ্রমী (গ্রাম) |
পরিশ্রমী(গ্রাম) |
পরিশ্রমহীন(গ্রাম) | মোটামুটি পরিশ্রমই(গ্রাম) | পরিশ্রমী(গ্রাম) |
শিম/বরবটি | 20 | 25 | 30 | 20 | 22.5 | 25 |
ডিম মাছ /মাংস |
1টি 30 |
1টি 30 |
1টি 30 |
1টি 30 |
1টি 30 |
1টি 30 |
পাতাযুক্ত সাক | 40 | 40 | 40 | 100 | 100 | 150 |
অন্যান্য সবজি | 60 | 70 | 80 | 40 | 40 | 100 |
আলু | 50 | 60 | 80 | 50 | 50 | 60 |
মধু | 150 | 200 | 250 | 100 | 150 | 200 |
তেল / চর্বি | 45 | 50 | 70 | 25 | 30 | 45 |
চিনি/গুড় | 30 | 35 | 55 | 20 | 20 | 40 |
তালিকা (b): বাংলাদেশের সাধারণ খাদ্যসমূহের পুষ্টিমান
বাংলাদেশের সাধারণ খাদ্যশস্যগুলোর খাদ্যমান বা পুষ্টিমানের উপর ভিত্তি করে এ ছকটি তৈরি করা হয়েছে। এটি The Institute of Nutrition and Food Science (INFS, 1975) কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রকাশিত একটি ছক। প্রতি 100 গ্রাম গ্রহণযোগ্য খাদ্যাংশের ভিত্তিতে ক্যালরি মান নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্যালরি মান কীভাবে বের করতে হয়, সেটি এই অধ্যায়েই বর্ণনা করা হয়েছে।
খাদ্য দ্রব্যের নাম (100 gram) | শক্তি (100gram) |
চাল | 346 |
গম(আটা) | 341 |
ছোলা | 360 |
মসুর | 343 |
গাজর | 48 |
গোল আলু | 97 |
কলমিশাক | 28 |
পুঁইশাক | 26 |
কুমড়া (ছোট) | 60 |
বেগুন | 24 |
ফুলকপি | 30 |
বাঁধাকপি | 27 |
বরবটি | 26 |
আরও দেখুন...